রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি: ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে থাকা ন্যায়বিচার

- Update Time : ০৭:১৪:১৪ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৫
- / 51
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল বাংলাদেশের ইতিহাসে ঘটে যায় এক ভয়াবহ শিল্প-দুর্যোগ। সেদিন সাভারের রানা প্লাজা নামক আটতলা ভবনটি ভেঙে পড়ে মুহূর্তেই। আর সেই ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে প্রাণ হারান ১ হাজার ১৩৬ জন পোশাক শ্রমিক। আহত হন প্রায় দেড় হাজার মানুষ, যাদের অনেকে চিরতরে পঙ্গু হয়ে যান। সেদিন যেন থেমে গিয়েছিল হাজারো স্বপ্নের কারখানার গতি, স্তব্ধ হয়েছিল পুরো দেশের বিবেক।
চারটি মামলা, কিন্তু শেষ হয়নি বিচার
এই ভয়াবহ ঘটনার পর দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় চারটি মামলা—
১️. হত্যা মামলা (অবহেলার কারণে মৃত্যু)
২️. ইমারত নির্মাণ আইন লঙ্ঘনের মামলা (রাজউক দায়ের)
৩️. দুর্নীতি মামলা (দুদক দায়ের)
৪️. সম্পদের তথ্য গোপনের মামলা (দুদক দায়ের)
এর মধ্যে কেবল চতুর্থ মামলাটির রায় হয়েছে। ২০১৭ সালের ২৯ আগস্ট সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে ভবন মালিক সোহেল রানাকে তিন বছরের কারাদণ্ড দেন ঢাকার বিশেষ জজ আদালত। সেই সঙ্গে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও তিন মাসের কারাদণ্ড।
হত্যা মামলায় ১১ বছরেও হয়নি রায়
বাকি তিন মামলার বিচার চলছে ধীরগতিতে।
২০১৬ সালে হত্যা ও ইমারত নির্মাণ আইনের মামলাগুলো বিচার প্রক্রিয়ার জন্য প্রস্তুত হয়। একই বছরের ১৫ ও ১৮ জুলাই দুটি মামলায় যথাক্রমে ১৮ ও ৪১ জন আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়।
- আদালতের তথ্য অনুযায়ী, হত্যা মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য ৫৯৪ জনকে তালিকাভুক্ত করা হয়, যার মধ্যে ১৬ জনের সাক্ষ্য ইতিমধ্যেই গ্রহণ করেছে আদালত।
- ইমারত নির্মাণ আইনের মামলায় সাক্ষী ১৩৫ জন।
- এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণও এখনো চলছে।
দুদকের দায়ের করা অন্য দুর্নীতির মামলাটিও এখনো বিচারাধীন। আর এসব মামলার প্রধান আসামি সোহেল রানা দীর্ঘ ১১ বছর ধরে কারাগারে বন্দি, কিন্তু এখনো পাননি জামিন কিংবা চূড়ান্ত রায়।
দুদকের দায়ের করা অন্য দুর্নীতির মামলাটিও এখনো বিচারাধীন। আর এসব মামলার প্রধান আসামি সোহেল রানা দীর্ঘ ১১ বছর ধরে কারাগারে বন্দি, কিন্তু এখনো পাননি জামিন কিংবা চূড়ান্ত রায়।
আইনি জটিলতা ও বিচার বিলম্ব
আসামিদের একাংশ উচ্চ আদালতে অভিযোগ গঠনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করেন। তাদের মধ্যে সাভার পৌরসভার তৎকালীন মেয়র রেফায়েত উল্লাহ ও কাউন্সিলর মোহাম্মদ আলী খানের বিরুদ্ধে হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ এখনো বহাল। ফলে মামলার অগ্রগতি থমকে আছে দীর্ঘদিন।
সোহেল রানার আইনজীবী বলেন, “এটা একটি দুর্ঘটনার মামলা। রানা ১১ বছর ধরে জেলে রয়েছেন। মানবিক বিবেচনায় তাকে জামিন দেওয়া উচিত।”
কে কোথায়: আসামি ও সাক্ষীদের তালিকা
- হত্যা মামলায় ৪১ জন আসামি, যাদের মধ্যে রানার বাবা আব্দুল খালেকসহ তিনজন জামিনে থাকা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন।
- ইমারত নির্মাণ মামলায় আসামি ১৮ জন।
- দুই মামলার ১৭ জন আসামি একই ব্যক্তি হওয়ায় মোট ব্যক্তি হিসেবে আসামি ৪২ জন।
মানবিক বিপর্যয়ের সংখ্যা চিত্র
- নিহত: ১,১৩৬ জন
- আহত: প্রায় ১,৫২৪ জন
- জীবিত উদ্ধার: ২,৪৩৮ জন
- অশনাক্ত লাশ: ২৯১টি (ডিএনএ নমুনা রেখে জুরাইন কবরস্থানে দাফন)
- পঙ্গু: ৭৮ জন
এক দশক পরে আজও সেই আর্তনাদ
রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়েছিল শুধু মানুষ নয়, দেশের শিল্প-গর্ব, নৈতিকতা এবং বিচারপ্রক্রিয়ার গতিও। গত এক দশকে তৈরি পোশাক খাত বহুগুণে বেড়েছে, দেশের অর্থনীতির চাকা আরও গতিশীল হয়েছে— কিন্তু বিচার না পাওয়ার আক্ষেপ যেন আজও সেই রক্তাক্ত পোশাকের মতোই লেগে আছে হাজারো পরিবারে।
প্রতিবছর ২৪ এপ্রিল আসে, চলে যায়—কিন্তু থেকে যায় হাজারো নিরীহ শ্রমিকের কান্না, প্রশ্ন ও অপূর্ণতার দীর্ঘশ্বাস।