বাংলাদেশে বিশ্ব পরিবেশ দিবস ও প্লাস্টিক দূষণ সচেতনতা

- Update Time : ০২:৩৬:১৭ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৫ জুন ২০২৫
- / 17
প্রতি বছর ৫ জুন বিশ্বজুড়ে পালিত হয় বিশ্ব পরিবেশ দিবস, যা জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি (UNEP) এর একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ। পরিবেশ রক্ষার সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৯৭৪ সাল থেকে এই দিবসটি পালন করা হচ্ছে। ২০২৫ সালের বিশ্ব পরিবেশ দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘প্লাস্টিক দূষণ আর নয়’। এই প্রতিপাদ্য শুধু একটি স্লোগান নয়, এটি একটি আহ্বান—প্লাস্টিক দূষণের বিরুদ্ধে আমাদের সক্রিয় ভূমিকা নিতে এখনই সময় এসেছে।
পরিবেশ রক্ষা: সময়ের অপরিহার্য দাবি
বর্তমান যুগে পরিবেশ দূষণ, জলবায়ু পরিবর্তন, বায়ুদূষণ ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি মানবজাতির জন্য ভয়াবহ সংকট সৃষ্টি করছে। প্লাস্টিক দূষণ তার মধ্যে অন্যতম। প্লাস্টিক ব্যবহারের বিস্তৃতি এবং এর অব্যবস্থাপনার কারণে পরিবেশ আজ বিপর্যয়ের মুখে। প্লাস্টিক বহু বছর ধরে ক্ষয় হয় না, ফলে নদী, সাগর ও ভূমিতে জমে গিয়ে জীববৈচিত্র্য বিনষ্ট করছে। মানুষের শরীরেও এর দূষণ পৌঁছে স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।
বিশ্বের নানা দেশেই প্লাস্টিক দূষণ নিয়ন্ত্রণে নানা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশেও গত কয়েক বছরে এই বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সরকার, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও নাগরিক সমাজ প্লাস্টিক দূষণ রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে।
বাংলাদেশে বিশ্ব পরিবেশ দিবসের আয়োজন ও কার্যক্রম
বাংলাদেশ সরকার পরিবেশ রক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রতিবার নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালন করে থাকে। ২০২৫ সালে ঈদুল আজহার সরকারি ছুটির কারণে আনুষ্ঠানিক দিবস পালন কিছুটা পিছিয়ে ২৫ জুন করা হবে। এই দিনটি পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় জাতীয় বৃক্ষরোপণ অভিযান ও মাসব্যাপী বৃক্ষমেলা এবং পরিবেশ মেলার উদ্বোধন করবে।
দেশব্যাপী ৬৪টি জেলায় একযোগে বৃক্ষরোপণ, প্লাস্টিক দূষণবিরোধী মানববন্ধন ও সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন অনুষ্ঠিত হবে। এতে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবীরা অংশগ্রহণ করে প্রতিটি জেলায় অন্তত ১০০টি করে গাছ রোপণ করবেন, যা বিদ্যালয়, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও বসতবাড়িতে স্থায়ীভাবে লাগানো হবে। পাশাপাশি দরিদ্র পরিবারের জন্য গাছ উপহার দেওয়া হবে।
প্লাস্টিক দূষণের ক্ষতিকর দিক নিয়ে স্থানীয় বিশেষজ্ঞরা জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বক্তব্য দেবেন। শহরের জনবহুল এলাকায় প্ল্যাকার্ড হাতে মানববন্ধন হবে এবং দোকান-বাজারে পোস্টার, লিফলেট বিতরণ ও জনসংযোগের মাধ্যমে প্লাস্টিক ব্যবহারের ক্ষতি ও পরিবেশবান্ধব বিকল্প ব্যবহারের গুরুত্ব তুলে ধরা হবে।
বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিভঙ্গি
বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) পরিচালক অধ্যাপক ড. কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, “৬৪ জেলায় একযোগে পরিবেশ কর্মসূচি বাস্তবায়ন একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় এর ধরণের উদ্যোগ খুবই প্রয়োজন। পরিবেশ রক্ষায় নাগরিক সচেতনতা ও অংশগ্রহণ বাড়ানো গেলে দেশের পরিবেশ উন্নত হবে।”
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) পলিসি ও ক্যাম্পেইন কো-অর্ডিনেটর বারীশ হাসান চৌধুরী বলেন, “পরিবেশগত ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হলে স্থানীয় পর্যায় থেকে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। প্লাস্টিক দূষণ রোধে বেলা দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে। এই আয়োজন সারা বিশ্বকে জানাবে—বাংলাদেশ প্লাস্টিক দূষণের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থানে রয়েছে।”
মিশন গ্রিন বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক আহসান রনি বলেন, “এই কর্মসূচি শুধু গাছ লাগানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি ভবিষ্যতের জন্য আশাবাদ, দায়িত্ব ও স্থায়িত্ব রোপণের প্রতীক। আমরা চাই, বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা সবুজ বিপ্লবের অংশীদার হয়ে উঠুক। এ উদ্যোগ সারা দেশের প্রতি অঞ্চলে ছড়িয়ে দিতে চাই।”
প্লাস্টিক দূষণের ভয়াবহ বাস্তবতা
জাতিসংঘের এক পরিসংখ্যানে বলা হয়, প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী প্রায় ৪০ কোটি টনের বেশি প্লাস্টিক তৈরি হয়, যার অর্ধেক একবার ব্যবহারের পর ফেলা হয়। এই প্লাস্টিকের মাত্র ৯ শতাংশ পুনর্ব্যবহার হয়। বাকি প্লাস্টিক নদী, সাগর, মাটি ও শহরের রাস্তার নিকাশির সঙ্গে মিশে থাকে, যা পরিবেশ ও মানুষের জীবনের জন্য মারাত্মক হুমকি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্লাস্টিক ব্যবহারে সীমাবদ্ধতা আরোপ করা, পুনর্ব্যবহারযোগ্য পণ্যের দিকে ঝোঁকানো এবং নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা ছাড়া দূষণ কমানো সম্ভব নয়। প্লাস্টিক দূষণ শুধু পরিবেশ নষ্ট করছে না, এটি প্রাণীর জীবনও হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে।
প্লাস্টিক দূষণ রোধে করণীয়
১. বিকল্প পণ্যের ব্যবহার: প্লাস্টিকের পরিবর্তে কাগজ, কাপড় বা বায়োডিগ্রেডেবল সামগ্রী ব্যবহার বাড়ানো জরুরি। দোকান-পাটে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের পরিবর্তে পরিবেশবান্ধব প্যাকেজিং বাধ্যতামূলক করতে হবে।
২. পুনর্ব্যবহার: প্লাস্টিক বর্জ্যের সঠিক পুনর্ব্যবহার ব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার। সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও সেগ্রিগেশন নিশ্চিত করা হলে প্লাস্টিক দূষণ অনেকাংশে কমানো সম্ভব।
৩. সচেতনতা: সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে প্লাস্টিক দূষণের ঝুঁকি ও বিকল্প ব্যবহারের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে হবে। স্কুল, কলেজ, সামাজিক সংগঠন ও মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার প্রয়োজন।
৪. নীতিমালা ও আইন প্রয়োগ: সরকারকে শক্তিশালী পরিবেশ নীতিমালা প্রণয়ন করে প্লাস্টিক দূষণ রোধে কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে। অবৈধ প্লাস্টিক বর্জ্য ফেলা ও উৎপাদনে নিষেধাজ্ঞা দেয়া যেতে পারে।
৫. গবেষণা ও উদ্ভাবন: পরিবেশবান্ধব নতুন পণ্যের উদ্ভাবন ও উৎপাদনে বিনিয়োগ বাড়ানো উচিত। এ ক্ষেত্রে তরুণ উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করতে হবে।
নাগরিকের দায়িত্ব ও প্রত্যাশা
পরিবেশ সংরক্ষণে সরকারের পাশাপাশি নাগরিকদেরও ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। প্রতিদিনকার জীবনে প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানো, সচেতনভাবে বর্জ্য ফেলা এবং গাছ লাগানোই পরিবেশ রক্ষায় বড় অবদান। শিশুদের ছোট থেকেই পরিবেশগত মূল্যবোধ শেখানো হলে ভবিষ্যতে তারা আরও দায়িত্বশীল নাগরিক হয়ে উঠবে।
বিশ্ব পরিবেশ দিবস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, পরিবেশ শুধু প্রকৃতির জন্য নয়, আমাদের নিজের জন্যই রক্ষা করতে হবে। ‘প্লাস্টিক দূষণ আর নয়’ এই প্রতিপাদ্য কেবল একটি স্লোগান নয়, এটি একটি দায়িত্ব ও প্রতিজ্ঞা।
বাংলাদেশ ও বিশ্ব: পথ চলার অগ্রাধিকার
বাংলাদেশ পরিবেশ দূষণ রোধে গত কয়েক বছরে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে। বৃক্ষরোপণ, পরিবেশবান্ধব নীতিমালা, প্লাস্টিক ব্যবহারে বিধিনিষেধ এবং সচেতনতা মূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে আরও কার্যকর পদক্ষেপ দরকার।
বিশ্বব্যাপী প্লাস্টিক দূষণ মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতাও জরুরি। প্রযুক্তি বিনিময়, তথ্য শেয়ারিং এবং অর্থায়ন বৃদ্ধির মাধ্যমে সব দেশকে একযোগে কাজ করতে হবে। কারণ পরিবেশ দূষণ কোনো দেশের সীমাবদ্ধ বিষয় নয়, এটি বৈশ্বিক সংকট।
শেষ কথা
৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয় পরিবেশের প্রতি দায়বদ্ধ থাকার গুরুত্ব। ‘প্লাস্টিক দূষণ আর নয়’ প্রতিপাদ্যের মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে সক্রিয় হওয়ার আহ্বান জানানো হয়। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের মানুষকে এখনই প্লাস্টিক দূষণ কমাতে একযোগে কাজ করতে হবে।
পরিবেশ রক্ষা করে আমরা আমাদের ও আগামী প্রজন্মের জন্য একটি সুন্দর, সবুজ ও সুস্থ পৃথিবী নিশ্চিত করতে পারি। এই মহৎ লক্ষ্যে সবাইকে অংশগ্রহণ করতে হবে, কারণ প্রকৃতির প্রতি সম্মান আর যত্ন ছাড়া মানবজীবন অসম্পূর্ণ।