বজ্রপাত থেকে বাঁচার উপায় ও করণীয়

- Update Time : ১১:১৪:১৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫
- / 48
বৈশাখ মাসে বাংলাদেশের আকাশে শুরু হয়ে গেছে বজ্রপাত ও বৃষ্টির মৌসুম। প্রতিবছর এই সময়ে বজ্রপাতের সংখ্যা ও প্রাণহানি উদ্বেগজনক হারে বেড়ে যায়। চলতি সপ্তাহেই দেশের ৯টি জেলায় বজ্রপাতে ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। কুমিল্লার দুই উপজেলায় চারজন, কিশোরগঞ্জের দুই উপজেলায় তিনজন, যশোর, মৌলভীবাজার, নেত্রকোণা, সুনামগঞ্জ, চাঁদপুর, খুলনা ও শরীয়তপুরে একজন করে নিহত হন। এত মৃত্যু আমাদের আরও সচেতন হওয়ার আহ্বান জানায়। আজকের আলোচনায় জানবো বজ্রপাত কেন হয় এবং এ সময়ে কী করণীয়।
বজ্রপাতের কারণ কী?
বজ্রপাতের মূল কারণ হলো আবহাওয়ার অস্থিতিশীলতা, যা সাধারণত গরম ও ঠান্ডা বাতাসের সংমিশ্রণ থেকে সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান বজ্রপাতের জন্য অত্যন্ত অনুকূল। একদিকে রয়েছে বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগর থেকে আসা উষ্ণ ও আর্দ্র বাতাস, অপরদিকে হিমালয় থেকে নেমে আসা ঠান্ডা বাতাস। এই দুই ধরনের বাতাসের সংঘাতে আকাশে সৃষ্টি হয় বজ্রগর্ভ মেঘ বা ‘কিউমুলোনিম্বাস’ মেঘ।
এই মেঘগুলির ঘর্ষণ থেকে প্রচণ্ড পরিমাণ ইলেকট্রিক চার্জ জমা হয়। যখন এই চার্জ ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে, তখন তা বজ্রপাত আকারে মাটির দিকে নেমে আসে। উচ্চ ভোল্টের বৈদ্যুতিক তরঙ্গ যখন মাটিতে নেমে আসে, তখন যে বস্তুটা সবচেয়ে কাছে বা সবচেয়ে উঁচু হয়, সেটিতে আঘাত করে।
গবেষকরা বলছেন, বায়ুদূষণ ও গ্লোবাল ওয়ার্মিং বজ্রপাতের সংখ্যা বাড়িয়ে তুলছে। তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গেলে বজ্রপাতের সম্ভাবনা প্রায় ৫০ শতাংশ বাড়ে। এ ছাড়া বড় বড় গাছ কেটে ফেলা, খোলা জায়গায় কাজ করা এবং বজ্রপাত সম্পর্কে সচেতনতার অভাবও প্রাণহানির অন্যতম কারণ।
কখন বেশি বজ্রপাত হয়?
পৃথিবীতে প্রতি মিনিটে প্রায় ৮০ লাখ বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে। বাংলাদেশে বজ্রপাতের মৌসুমি বৈচিত্র্য রয়েছে। মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয়ে থাকে। এই সময় বজ্রপাতের হার প্রায় ৫৯ শতাংশ। আবার জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত, বর্ষার সময়ে, বজ্রপাতের হার প্রায় ৩৬ শতাংশ।
বিশেষ করে এপ্রিল থেকে জুন মাস — এই তিন মাসে মোট বজ্রপাতের প্রায় ৭০ শতাংশ সংঘটিত হয়। এর মধ্যে মে মাসকে সবচেয়ে বিপজ্জনক ধরা হয়, কারণ এই মাসে গড়ে ২৬ শতাংশ দুর্যোগ বজ্রপাতের মাধ্যমে ঘটে।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৯–২০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ৩১ লাখ ৩৩ হাজারের বেশি বজ্রপাত রেকর্ড করা হয়েছে, যা আমাদের দেশের জন্য একটি ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে।
বজ্রপাতের সময় কী কী সমস্যা হয়?
বজ্রপাতের সরাসরি আঘাতে শরীরের ভেতরে বৈদ্যুতিক শক তৈরি হয়। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় হৃদযন্ত্র ও মস্তিষ্ক। বজ্রাঘাতে আক্রান্ত ব্যক্তির শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যেতে পারে, হার্ট বিট থেমে যেতে পারে বা মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা নষ্ট হতে পারে।
অনেক সময় বজ্রাঘাতে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরের এক বা একাধিক অঙ্গ প্যারালাইজড হয়ে যায়। যারা বজ্রপাত থেকে বেঁচে যান, তাদের অনেকেই আজীবন জটিল শারীরিক সমস্যায় ভোগেন। তাই বজ্রপাতকে শুধুমাত্র একটি আবহাওয়া বিষয়ক দুর্ঘটনা হিসেবে না দেখে এটি একটি “কমিউনিটি হেলথ ইস্যু” হিসেবে বিবেচনা করা উচিত।
বজ্রপাতের সময় করণীয় কী?
বজ্রপাত প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়, তবে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সতর্কতা মেনে চললে প্রাণহানি ও দুর্ঘটনা কমানো যেতে পারে।
বাহিরে অবস্থানকালীন করণীয়:
- খোলা মাঠ, নদী, পুকুর বা জলাশয়ের কাছাকাছি অবস্থান করবেন না।
- উচ্চতা বিশিষ্ট গাছ বা ল্যাম্পপোস্টের নিচে দাঁড়াবেন না।
- ধাতব বস্তু যেমন ছাতা, লাঠি, সাইকেল, মোটরবাইক ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন।
- খোলা স্থানে থাকলে দুই পায়ের মাঝখানে দূরত্ব রেখে নিচু হয়ে বসুন এবং দুই হাত দিয়ে কানের চারপাশ চেপে ধরুন।
- দৌড়াবেন না বা শুয়ে পড়বেন না, কারণ এতে বজ্রপাতের আঘাতের আশঙ্কা বাড়ে।
ঘরের ভেতরে করণীয়:
- দরজা-জানালার ধারে বা খোলা জানালার সামনে দাঁড়াবেন না।
- ইলেকট্রনিক ডিভাইস, যেমন টিভি, কম্পিউটার, মোবাইল ফোন চার্জে দেওয়া, ফ্রিজ ইত্যাদি ব্যবহার এড়িয়ে চলুন।
- বৈদ্যুতিক তার, পানির পাইপ বা অন্য কোনো ধাতব জিনিসের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলুন।
- WiFi রাউটার বা টিভির মতো বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি প্লাগ থেকে খুলে রাখুন।
পানিতে থাকলে করণীয়:
- বজ্রপাতের সময় সাঁতার, মাছ ধরা, নৌকায় থাকা ইত্যাদি একেবারেই নিষেধ।
- পানিতে থাকলে দ্রুত পানি থেকে উঠে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিন।
বজ্রপাতের সময় প্রাথমিক চিকিৎসা:
কেউ বজ্রাঘাতে অজ্ঞান হয়ে পড়লে:
- প্রথমেই পরীক্ষা করুন, আক্রান্ত ব্যক্তি শ্বাস নিচ্ছেন কিনা।
- যদি না নেয়, তাহলে অবিলম্বে সিপিআর (CPR) শুরু করুন।
- দ্রুত নিকটবর্তী হাসপাতালে নিয়ে যান।
- আহত ব্যক্তি জীবিত থাকলেও, তার শারীরিক অবস্থা পরীক্ষা করাতে হাসপাতালে নিতে হবে, কারণ অভ্যন্তরীণ ক্ষতি থাকতে পারে।
ব্যক্তিগত ও সামাজিক সতর্কতা:
- বজ্রপাতের সময় আবহাওয়ার পূর্বাভাস নিয়মিত মনিটর করুন।
- স্থানীয় প্রশাসনের বজ্রপাত সংক্রান্ত সতর্ক বার্তা মেনে চলুন।
- গ্রামগঞ্জে বিশেষ করে কৃষকদের বজ্রপাত সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
- বজ্রপাতের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলিতে কমিউনিটি-ভিত্তিক আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা যেতে পারে।
- স্কুল, কলেজ, ইউনিয়ন পর্যায়ে সচেতনতামূলক কর্মসূচি চালু করা জরুরি।
উপসংহার
বজ্রপাত প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলেও, সচেতনতা ও সতর্কতা মেনে চললে প্রাণহানি কমানো সম্ভব। পরিবেশ দূষণ কমিয়ে গাছ লাগানো, নিরাপদ জীবনযাত্রার অভ্যাস গড়ে তোলা এবং ব্যক্তিগত সতর্কতা বজায় রাখার মাধ্যমেই আমরা নিজেদের ও আমাদের পরিবার-পরিজনকে বজ্রপাতের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা করতে পারি।