বাংলাদেশ কি উন্নতির পথে – নাকি একই ভুল বারবার?

- Update Time : ০১:০৫:৪০ অপরাহ্ন, শনিবার, ৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
- / 290
বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, শিল্পায়ন এবং অবকাঠামো উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। তবে, দেশটি এখনও শাসনব্যবস্থা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, ব্যাংকিং খাতের সংকট এবং শিল্প বৈচিত্র্যকরণের মতো বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। উন্নত দেশগুলোর দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথে সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, জার্মানির মতো সফল অর্থনীতিগুলোর অভিজ্ঞতা থেকে বাংলাদেশের অনেক কিছু শেখার আছে। এই নিবন্ধে ১৯৫২ সাল থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের ঐতিহাসিক ভুলগুলোর বিশ্লেষণ করা হবে এবং সেগুলোর তুলনা করা হবে উন্নত দেশগুলোর কৌশল ও সাফল্যের সাথে।
রাজনৈতিক অস্থিরতা: টেকসই উন্নয়নের প্রধান বাধা
বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো রাজনৈতিক অস্থিরতা। ১৯৫২ সাল থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত দেশটি একাধিক সামরিক অভ্যুত্থান, স্বৈরশাসন এবং আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে ক্ষমতার লড়াই প্রত্যক্ষ করেছে।
উন্নত দেশের অভিজ্ঞতা:
- দক্ষিণ কোরিয়া: কোরিয়ান যুদ্ধের পর দেশটি রাজনৈতিক অস্থিরতার সম্মুখীন হয়েছিল। তবে, দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনের মাধ্যমে তারা আজ বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে।
- জার্মানি: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর রাজনৈতিক ঐকমত্য গঠন করে দ্রুত অর্থনৈতিক পুনর্গঠনে সফল হয়।
- বাংলাদেশের ভুল: ঘন ঘন হরতাল, রাজনৈতিক সহিংসতা এবং নীতিগত অস্থিরতা বিদেশি বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করেছে এবং শিল্পোন্নয়নকে ব্যাহত করেছে।
অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ ও ব্যাংকিং খাতের সংকট
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত ঋণ খেলাপি, দুর্নীতি এবং দুর্বল নিয়ন্ত্রক কাঠামোর সমস্যায় জর্জরিত। স্বল্পমেয়াদী লাভের দিকে মনোযোগ দেয়ার ফলে ব্যাংকিং সংকট ঘন ঘন দেখা দিয়েছে।
উন্নত দেশের অভিজ্ঞতা:
- সিঙ্গাপুর: কঠোর আর্থিক নিয়ন্ত্রণ ও দুর্নীতিমুক্ত ব্যাংকিং ব্যবস্থা গড়ে তুলে বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করেছে।
- যুক্তরাষ্ট্র: ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য শক্তিশালী সরকারি হস্তক্ষেপ এবং নীতি সংস্কার গ্রহণ করেছে।
- বাংলাদেশের ভুল: ঋণ খেলাপির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়া, রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত আর্থিক সিদ্ধান্ত এবং দুর্বল নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা অর্থনৈতিক আস্থার সংকট সৃষ্টি করেছে।
শিল্প উন্নয়ন: নীতিগত ব্যর্থতায় বিলম্বিত অগ্রগতি
বাংলাদেশের শিল্প খাত মূলত পোশাক শিল্পের উপর নির্ভরশীল, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য যথেষ্ট নয়। উন্নত দেশগুলো শিল্প বৈচিত্র্য ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নে বিনিয়োগ করেছে।
উন্নত দেশের অভিজ্ঞতা:
- জাপান: উন্নত প্রযুক্তি ও স্বয়ংক্রিয় উৎপাদনে বিনিয়োগ করে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরাশক্তি হয়ে উঠেছে।
- চীন: স্বল্প খরচের উৎপাদন থেকে উচ্চ প্রযুক্তির শিল্পে রূপান্তরিত হয়েছে।
- বাংলাদেশের ভুল: পোশাক শিল্পের উপর অতিরিক্ত নির্ভরতা এবং প্রযুক্তি ভিত্তিক শিল্পায়নে বিনিয়োগের ঘাটতি।
দুর্নীতি ও শাসনব্যবস্থার দুর্বলতা
বাংলাদেশে দুর্নীতি বড় একটি প্রতিবন্ধকতা। প্রশাসনিক খাত থেকে শুরু করে সরকারি প্রকল্পগুলোর ব্যয়ে অনিয়ম ব্যাপকভাবে বিদ্যমান।
উন্নত দেশের অভিজ্ঞতা:
- ডেনমার্ক: দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে বিশ্বের সবচেয়ে স্বচ্ছ দেশগুলোর মধ্যে অবস্থান নিয়েছে।
- সুইডেন: রাজনৈতিক ও কর্পোরেট স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে সংস্থাগত সংস্কার এনেছে।
- বাংলাদেশের ভুল: দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নেওয়া এবং সরকারি প্রকল্পগুলোতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত না করা।
অবকাঠামো ও নগর পরিকল্পনার ব্যর্থতা
বাংলাদেশে দ্রুত নগরায়নের ফলে যানজট, অপরিকল্পিত নগর বিস্তার এবং পরিবেশগত সংকট দেখা দিয়েছে। উন্নত দেশগুলো পরিকল্পিত নগর ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এই সমস্যাগুলো মোকাবিলা করেছে।
উন্নত দেশের অভিজ্ঞতা:
- দুবাই (UAE): অত্যাধুনিক অবকাঠামো ও সুপরিকল্পিত নগর ব্যবস্থা তৈরি করেছে।
- জার্মানি: উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলে শহরে যানজট কমিয়েছে।
- বাংলাদেশের ভুল: অপরিকল্পিত নগর উন্নয়ন, পরিবেশগত নিয়মের অভাব, এবং সুষ্ঠু নগর পরিকল্পনার অভাব।
শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়নের ঘাটতি
একটি শক্তিশালী শিক্ষাব্যবস্থা যে কোনো উন্নত দেশের ভিত্তি। বাংলাদেশে শিক্ষার হার বেড়েছে, তবে দক্ষ জনবল তৈরিতে পিছিয়ে আছে।
উন্নত দেশের অভিজ্ঞতা:
- ফিনল্যান্ড: সৃজনশীলতা ও সমস্যা সমাধানের ওপর ভিত্তি করে মানসম্পন্ন শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে।
- দক্ষিণ কোরিয়া: শিল্প খাতের চাহিদার সাথে সামঞ্জস্য রেখে কারিগরি শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিয়েছে।
- বাংলাদেশের ভুল: সময়োপযোগী পাঠ্যক্রমের অভাব, গবেষণার ঘাটতি এবং পর্যাপ্ত অর্থায়নের অভাব।
উপসংহার: ভবিষ্যৎ পথচলা
উন্নত দেশের কাতারে যেতে হলে বাংলাদেশকে অবশ্যই নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর ওপর গুরুত্ব দিতে হবে:
- রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা: গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা ও নীতিগত স্থিতিশীলতা বজায় রাখা।
- অর্থনৈতিক সংস্কার: ব্যাংকিং খাতে কঠোর নিয়ন্ত্রণ ও বিনিয়োগবান্ধব নীতি গ্রহণ।
- শিল্প বৈচিত্র্যকরণ: প্রযুক্তিভিত্তিক শিল্পায়নে বিনিয়োগ।
- দুর্নীতি দমন: কার্যকর প্রশাসনিক সংস্কার ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা।
- অবকাঠামো উন্নয়ন: পরিকল্পিত নগরায়ন ও পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন।
- শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়ন: গবেষণা ও প্রযুক্তিগত দক্ষতার উন্নয়ন।
বাংলাদেশের রয়েছে অসাধারণ সম্ভাবনা। অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সুপরিকল্পিত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে গেলে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের তালিকায় স্থান করে নেওয়া অসম্ভব নয়।