Dhaka ০৬:০০ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২১ মে ২০২৫
শিরোনাম :

‘মার্চ টু ঢাকা’ দমন: জাতিসংঘের প্রতিবেদনে চাঞ্চল্যকর তথ্য ফাঁস

  • Update Time : ১০:০০:১৭ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
  • / 36

গত ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঠেকাতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দুই দফা উচ্চপর্যায়ের বৈঠক হয়। জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনের (ওএইচসিএইচআর) এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, এই কর্মসূচি দমনে সরকার কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল, যার মধ্যে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগও রয়েছে।

সরকারের কৌশলগত পরিকল্পনা

প্রতিবেদনে বলা হয়, আন্দোলনরত নেতাদের ঘোষণার পাশাপাশি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্যের ভিত্তিতে সরকার জানতে পারে, ৫ আগস্ট ঢাকার কেন্দ্রস্থলে একটি বিশাল বিক্ষোভ মিছিলের পরিকল্পনা রয়েছে। সেই প্রেক্ষিতে ৪ আগস্ট সকালে জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে সেনা, বিমান, নৌ, বিজিবি, ডিজিএফআই, এনএসআই, পুলিশসহ সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সেখানে ‘মার্চ অন ঢাকা’ প্রতিরোধে কারফিউ জারি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

কঠোর দমন নীতির ঘোষণা

বৈঠকের পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক ঘোষণায় জানায়, অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি থাকবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্দোলনকারীদের ‘সন্ত্রাসী’ আখ্যা দিয়ে দেশবাসীকে ‘এই সন্ত্রাসীদের শক্ত হাতে দমন’ করার আহ্বান জানান। একই দিন সন্ধ্যায় গণভবনে আরেকটি বৈঠক হয়, যেখানে নিরাপত্তা বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা চূড়ান্ত করা হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী, প্রয়োজন হলে কঠোর শক্তি প্রয়োগ করে বিক্ষোভকারীদের ঢাকার কেন্দ্রস্থলে প্রবেশে বাধা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

প্রতিরোধ পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন

৫ আগস্ট রাত ১২টা ৫৫ মিনিটে বিজিবির মহাপরিচালককে দুটি হোয়াটসঅ্যাপ বার্তা পাঠানো হয়, যেখানে আন্দোলনকারীদের গতিবিধির তথ্য ও প্রতিরক্ষামূলক কৌশল তুলে ধরা হয়। সেনাবাহিনী ও বিজিবিকে ঢাকার প্রবেশপথগুলো অবরুদ্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হলেও, জাতিসংঘের প্রতিবেদনে উঠে আসে যে, তারা যথাযথ ভূমিকা পালন করেনি।

এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা সাক্ষ্য দেন, সেনাবাহিনী তাদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী অবস্থান নেয়নি। অন্য এক কর্মকর্তা জানান, বিজিবি প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ১০-১৫ হাজার বিক্ষোভকারীকে ঢাকায় প্রবেশ করতে দেয়। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, ৫০০-৬০০ জন বিক্ষোভকারী সেনাবাহিনীর বাধা ছাড়াই ঢাকায় প্রবেশ করেছে।

পুলিশের প্রাণঘাতী হামলা ও হতাহতের সংখ্যা

‘মার্চ অন ঢাকা’ প্রতিরোধে পুলিশের ভূমিকা ছিল সবচেয়ে কঠোর। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়, পুলিশ শহরের বিভিন্ন স্থানে প্রাণঘাতী গুলি চালায়, যার ফলে বহু আন্দোলনকারী নিহত হন। পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, সেনাবাহিনী আগেই বুঝতে পেরেছিল শেখ হাসিনার সরকার টিকতে পারবে না, কিন্তু পুলিশ তা জানতো না। তাই তারা পুরোপুরি দমননীতি অনুসরণ করে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, পুলিশ যাকে সামনে পেয়েছে, তাকেই লক্ষ্য করে গুলি চালিয়েছে। এমনকি আওয়ামী লীগ সমর্থকরাও বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালিয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া, কিছু আন্দোলনকারী পুলিশের ওপর ইট-পাটকেল ছোড়ার ঘটনা ঘটলেও পুলিশ ও আনসার সদস্যরা গুলি চালিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে।

শেখ হাসিনার দেশত্যাগ ও পরবর্তী পরিস্থিতি

৫ আগস্ট দুপুরের দিকে শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করেন। বিকেলে ছাত্র-জনতা তার পতন উদযাপন শুরু করলে, পুলিশ টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। এ সময় কিছু লাশ পুড়িয়ে ফেলা হয় এবং সাভার ও আশুলিয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় ভয়াবহ সহিংসতার খবর পাওয়া যায়।

জাতিসংঘের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, আন্দোলন দমন করতে গিয়ে সাধারণ মানুষ, রিকশাচালক ও আন্দোলনকারীদের পাশাপাশি কিছু পুলিশ সদস্যও প্রাণ হারান। এই ঘটনাগুলো বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নতুন মোড় নিয়ে এসেছে, যা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নজরে এসেছে।

আপনার সোশ্যাল মিডিয়া এই পোস্ট শেয়ার করুন

Cricket Update

‘মার্চ টু ঢাকা’ দমন: জাতিসংঘের প্রতিবেদনে চাঞ্চল্যকর তথ্য ফাঁস

Update Time : ১০:০০:১৭ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

গত ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঠেকাতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দুই দফা উচ্চপর্যায়ের বৈঠক হয়। জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনের (ওএইচসিএইচআর) এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, এই কর্মসূচি দমনে সরকার কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল, যার মধ্যে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগও রয়েছে।

সরকারের কৌশলগত পরিকল্পনা

প্রতিবেদনে বলা হয়, আন্দোলনরত নেতাদের ঘোষণার পাশাপাশি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্যের ভিত্তিতে সরকার জানতে পারে, ৫ আগস্ট ঢাকার কেন্দ্রস্থলে একটি বিশাল বিক্ষোভ মিছিলের পরিকল্পনা রয়েছে। সেই প্রেক্ষিতে ৪ আগস্ট সকালে জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে সেনা, বিমান, নৌ, বিজিবি, ডিজিএফআই, এনএসআই, পুলিশসহ সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সেখানে ‘মার্চ অন ঢাকা’ প্রতিরোধে কারফিউ জারি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

কঠোর দমন নীতির ঘোষণা

বৈঠকের পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক ঘোষণায় জানায়, অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি থাকবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্দোলনকারীদের ‘সন্ত্রাসী’ আখ্যা দিয়ে দেশবাসীকে ‘এই সন্ত্রাসীদের শক্ত হাতে দমন’ করার আহ্বান জানান। একই দিন সন্ধ্যায় গণভবনে আরেকটি বৈঠক হয়, যেখানে নিরাপত্তা বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা চূড়ান্ত করা হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী, প্রয়োজন হলে কঠোর শক্তি প্রয়োগ করে বিক্ষোভকারীদের ঢাকার কেন্দ্রস্থলে প্রবেশে বাধা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

প্রতিরোধ পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন

৫ আগস্ট রাত ১২টা ৫৫ মিনিটে বিজিবির মহাপরিচালককে দুটি হোয়াটসঅ্যাপ বার্তা পাঠানো হয়, যেখানে আন্দোলনকারীদের গতিবিধির তথ্য ও প্রতিরক্ষামূলক কৌশল তুলে ধরা হয়। সেনাবাহিনী ও বিজিবিকে ঢাকার প্রবেশপথগুলো অবরুদ্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হলেও, জাতিসংঘের প্রতিবেদনে উঠে আসে যে, তারা যথাযথ ভূমিকা পালন করেনি।

এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা সাক্ষ্য দেন, সেনাবাহিনী তাদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী অবস্থান নেয়নি। অন্য এক কর্মকর্তা জানান, বিজিবি প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ১০-১৫ হাজার বিক্ষোভকারীকে ঢাকায় প্রবেশ করতে দেয়। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, ৫০০-৬০০ জন বিক্ষোভকারী সেনাবাহিনীর বাধা ছাড়াই ঢাকায় প্রবেশ করেছে।

পুলিশের প্রাণঘাতী হামলা ও হতাহতের সংখ্যা

‘মার্চ অন ঢাকা’ প্রতিরোধে পুলিশের ভূমিকা ছিল সবচেয়ে কঠোর। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়, পুলিশ শহরের বিভিন্ন স্থানে প্রাণঘাতী গুলি চালায়, যার ফলে বহু আন্দোলনকারী নিহত হন। পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, সেনাবাহিনী আগেই বুঝতে পেরেছিল শেখ হাসিনার সরকার টিকতে পারবে না, কিন্তু পুলিশ তা জানতো না। তাই তারা পুরোপুরি দমননীতি অনুসরণ করে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, পুলিশ যাকে সামনে পেয়েছে, তাকেই লক্ষ্য করে গুলি চালিয়েছে। এমনকি আওয়ামী লীগ সমর্থকরাও বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালিয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া, কিছু আন্দোলনকারী পুলিশের ওপর ইট-পাটকেল ছোড়ার ঘটনা ঘটলেও পুলিশ ও আনসার সদস্যরা গুলি চালিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে।

শেখ হাসিনার দেশত্যাগ ও পরবর্তী পরিস্থিতি

৫ আগস্ট দুপুরের দিকে শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করেন। বিকেলে ছাত্র-জনতা তার পতন উদযাপন শুরু করলে, পুলিশ টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। এ সময় কিছু লাশ পুড়িয়ে ফেলা হয় এবং সাভার ও আশুলিয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় ভয়াবহ সহিংসতার খবর পাওয়া যায়।

জাতিসংঘের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, আন্দোলন দমন করতে গিয়ে সাধারণ মানুষ, রিকশাচালক ও আন্দোলনকারীদের পাশাপাশি কিছু পুলিশ সদস্যও প্রাণ হারান। এই ঘটনাগুলো বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নতুন মোড় নিয়ে এসেছে, যা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নজরে এসেছে।