Dhaka ০৯:১৭ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২০ মে ২০২৫
শিরোনাম :

মিনিকেট চালের কারসাজি

  • Update Time : ০৯:৪৬:০৭ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৮ মার্চ ২০২৫
  • / 80

মিনিকেট চালের কারসাজি: চকচকে চালের আড়ালে অন্ধকারের গল্প

রমজান এলেই বাজারে এক ধরনের অদ্ভুত খেলা শুরু হয়। পেঁয়াজ, তেল, চিনি—সবকিছুর দাম একটু একটু করে বেড়ে যায়, তারপর সরকার হস্তক্ষেপ করলে ধীরে ধীরে কমতে থাকে। কিন্তু এবার চালের বাজারে যে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে মিনিকেট চালের দাম নিয়ে চলছে বড় ধরনের কারসাজি।

রমজানের সময় সাধারণত চালের চাহিদা কমে যায়, ফলে দামও কম থাকার কথা। কিন্তু এবার উল্টো হয়েছে! মাত্র দুই সপ্তাহের ব্যবধানে মিনিকেট চালের দাম কেজিতে ৮ থেকে ১০ টাকা বেড়ে গেছে। রাজধানীর কাওরান বাজার, বাবুবাজার ও অন্যান্য পাইকারি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, মানভেদে এই চালের কেজি ৮৫ টাকায় পৌঁছে গেছে। অথচ কয়েক সপ্তাহ আগেও এই চাল ৭০-৭৫ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছিল।

মিনিকেট চাল: সত্য নাকি বিভ্রান্তি?

বাজারে চকচকে, সরু মিনিকেট চালের ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে। অনেকেই মনে করেন, এটি কোনো উন্নত জাতের ধান থেকে তৈরি হয়। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) স্পষ্টভাবে জানিয়েছে, “মিনিকেট” নামে কোনো ধানের জাত নেই। তাহলে এই নাম এল কোথা থেকে?

ব্যবসায়ীরা সাধারণত ব্রি ধান-২৮, ব্রি ধান-২৯, কাজল লতা ও হাইব্রিড জাতের মোটা ধানকে আধুনিক মেশিনে উচ্চমাত্রায় পলিশ করে মিনিকেট নামে বাজারজাত করেন। পলিশ করার ফলে চাল দেখতে সুন্দর ও চকচকে হয়, ফলে অনেকেই এটিকে বেশি পুষ্টিকর বলে মনে করেন। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, এই উচ্চ পলিশিং পদ্ধতিতে চালের আসল পুষ্টিগুণ নষ্ট হয়ে যায়, এবং এতে শুধু ক্যালরি বাড়ে, কিন্তু ভিটামিন ও মিনারেল কমে যায়।

একটি মজার তথ্য হলো, “মিনিকেট” নামটি এসেছে ভারতের “Minikit” কর্মসূচি থেকে। একসময় ভারত সরকার কৃষকদের উন্নত জাতের ধানের বীজ বিনামূল্যে সরবরাহ করত, যা মিনিকিট নামে পরিচিত ছিল। সেখান থেকে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা “মিনিকেট” নামটি চালের জন্য ব্যবহার করা শুরু করেন। এখন এই নামেই বাজারে একটি শক্তিশালী ব্র্যান্ড তৈরি হয়েছে, যা ভোক্তাদের বিভ্রান্ত করছে।

বাজারে দাম বাড়ার আসল খেলা

চালের দাম কেন বাড়ছে? ব্যবসায়ীদের বক্তব্য হলো, বাজারে মিনিকেট চালের সরবরাহ কম। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি মূলত একটি পরিকল্পিত কারসাজি।

কাওরান বাজারের এক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “চালের কোনো সংকট নেই। যাদের গুদামে মজুত আছে, তারা পরিকল্পিতভাবে অল্প অল্প করে বাজারে ছাড়ছেন, যাতে দাম বাড়ে। এটি পুরোটাই কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বেশি মুনাফা করার কৌশল।”

সরকারি বিপণন সংস্থা টিসিবির (ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ) তথ্য অনুযায়ী, গত বছর এই সময় মিনিকেট চালের দাম ছিল ৬২ থেকে ৭৫ টাকা। মোটা চাল ইরি/স্বর্ণার দাম ছিল ৪৮ থেকে ৫২ টাকা। কিন্তু এবার দাম বেড়ে ৮৫ টাকা পর্যন্ত পৌঁছেছে। অর্থাৎ এক বছরেই প্রতি কেজিতে ১০-১৫ টাকার বৃদ্ধি!

সরকার কি কিছু করছে?

খাদ্য মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে, “মিনিকেট নামে চাল বাজারজাত করা যাবে না।” কারণ এটি কোনো বৈধ জাত নয়, বরং ব্যবসায়ীদের তৈরি করা একটি ব্র্যান্ড।

এছাড়া, সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য ওএমএস (ওপেন মার্কেট সেল), খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি এবং টিসিবির মাধ্যমে ৭ লাখ টন চাল বিতরণের পরিকল্পনা করেছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এসব উদ্যোগ আদৌ বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে কি?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের মনিটরিং ব্যবস্থা দুর্বল হলে এই ধরনের কৌশলগত কারসাজি রোধ করা কঠিন। বাজারের অসাধু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য কমাতে হলে নিয়মিত তদারকি ও কড়া নজরদারি প্রয়োজন।

ভোক্তারা কী করবেন?

চালের দাম নিয়ন্ত্রণের জন্য শুধু সরকার নয়, ভোক্তাদেরও সচেতন হতে হবে।
বিকল্প চাল ব্যবহার করুন: মিনিকেট চালের প্রতি নির্ভরশীলতা কমানো দরকার। নাজিরশাইল, স্বর্ণা, কিংবা স্থানীয় কৃষকদের উৎপাদিত মোটা চাল ব্যবহার করতে পারেন।
স্থানীয় কৃষকদের উৎসাহ দিন: স্থানীয় কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি চাল কেনার চেষ্টা করুন। এতে মধ্যস্বত্বভোগীদের কারসাজি কমবে।
বাজারের তথ্য জানুন: কোথায় কোন চাল কত দামে বিক্রি হচ্ছে, তা জেনে নিন। অনেক সময় কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ইচ্ছাকৃতভাবে দাম বাড়িয়ে ভোক্তাদের ঠকানোর চেষ্টা করেন।

উপসংহার

চালের বাজারে কারসাজি নতুন কিছু নয়, তবে এবারের পরিস্থিতি বেশ জটিল। মিনিকেট নামে বাজারে চাল বিক্রি করা আসলে একটি বাণিজ্যিক প্রতারণা। এর পাশাপাশি, ব্যবসায়ীদের মজুতদারি ও কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়ানোর প্রবণতা সাধারণ মানুষকে চরম বিপাকে ফেলেছে। সরকার যদি শক্ত পদক্ষেপ নেয়, নিয়মিত বাজার মনিটরিং করে এবং অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে, তাহলে এই পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব।

কিন্তু বড় প্রশ্ন থেকে যায়—বাজার কারসাজির এই খেলা কবে বন্ধ হবে? আর সাধারণ জনগণ কতদিন ধরে এই প্রতারণার শিকার হবে? আপনার মতামত কী? বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের ভূমিকা কতটা কার্যকর বলে আপনি মনে করেন?

নিউজ সোর্চ

আপনার সোশ্যাল মিডিয়া এই পোস্ট শেয়ার করুন

Cricket Update

মিনিকেট চালের কারসাজি

Update Time : ০৯:৪৬:০৭ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৮ মার্চ ২০২৫

মিনিকেট চালের কারসাজি: চকচকে চালের আড়ালে অন্ধকারের গল্প

রমজান এলেই বাজারে এক ধরনের অদ্ভুত খেলা শুরু হয়। পেঁয়াজ, তেল, চিনি—সবকিছুর দাম একটু একটু করে বেড়ে যায়, তারপর সরকার হস্তক্ষেপ করলে ধীরে ধীরে কমতে থাকে। কিন্তু এবার চালের বাজারে যে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে মিনিকেট চালের দাম নিয়ে চলছে বড় ধরনের কারসাজি।

রমজানের সময় সাধারণত চালের চাহিদা কমে যায়, ফলে দামও কম থাকার কথা। কিন্তু এবার উল্টো হয়েছে! মাত্র দুই সপ্তাহের ব্যবধানে মিনিকেট চালের দাম কেজিতে ৮ থেকে ১০ টাকা বেড়ে গেছে। রাজধানীর কাওরান বাজার, বাবুবাজার ও অন্যান্য পাইকারি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, মানভেদে এই চালের কেজি ৮৫ টাকায় পৌঁছে গেছে। অথচ কয়েক সপ্তাহ আগেও এই চাল ৭০-৭৫ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছিল।

মিনিকেট চাল: সত্য নাকি বিভ্রান্তি?

বাজারে চকচকে, সরু মিনিকেট চালের ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে। অনেকেই মনে করেন, এটি কোনো উন্নত জাতের ধান থেকে তৈরি হয়। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) স্পষ্টভাবে জানিয়েছে, “মিনিকেট” নামে কোনো ধানের জাত নেই। তাহলে এই নাম এল কোথা থেকে?

ব্যবসায়ীরা সাধারণত ব্রি ধান-২৮, ব্রি ধান-২৯, কাজল লতা ও হাইব্রিড জাতের মোটা ধানকে আধুনিক মেশিনে উচ্চমাত্রায় পলিশ করে মিনিকেট নামে বাজারজাত করেন। পলিশ করার ফলে চাল দেখতে সুন্দর ও চকচকে হয়, ফলে অনেকেই এটিকে বেশি পুষ্টিকর বলে মনে করেন। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, এই উচ্চ পলিশিং পদ্ধতিতে চালের আসল পুষ্টিগুণ নষ্ট হয়ে যায়, এবং এতে শুধু ক্যালরি বাড়ে, কিন্তু ভিটামিন ও মিনারেল কমে যায়।

একটি মজার তথ্য হলো, “মিনিকেট” নামটি এসেছে ভারতের “Minikit” কর্মসূচি থেকে। একসময় ভারত সরকার কৃষকদের উন্নত জাতের ধানের বীজ বিনামূল্যে সরবরাহ করত, যা মিনিকিট নামে পরিচিত ছিল। সেখান থেকে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা “মিনিকেট” নামটি চালের জন্য ব্যবহার করা শুরু করেন। এখন এই নামেই বাজারে একটি শক্তিশালী ব্র্যান্ড তৈরি হয়েছে, যা ভোক্তাদের বিভ্রান্ত করছে।

বাজারে দাম বাড়ার আসল খেলা

চালের দাম কেন বাড়ছে? ব্যবসায়ীদের বক্তব্য হলো, বাজারে মিনিকেট চালের সরবরাহ কম। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি মূলত একটি পরিকল্পিত কারসাজি।

কাওরান বাজারের এক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “চালের কোনো সংকট নেই। যাদের গুদামে মজুত আছে, তারা পরিকল্পিতভাবে অল্প অল্প করে বাজারে ছাড়ছেন, যাতে দাম বাড়ে। এটি পুরোটাই কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বেশি মুনাফা করার কৌশল।”

সরকারি বিপণন সংস্থা টিসিবির (ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ) তথ্য অনুযায়ী, গত বছর এই সময় মিনিকেট চালের দাম ছিল ৬২ থেকে ৭৫ টাকা। মোটা চাল ইরি/স্বর্ণার দাম ছিল ৪৮ থেকে ৫২ টাকা। কিন্তু এবার দাম বেড়ে ৮৫ টাকা পর্যন্ত পৌঁছেছে। অর্থাৎ এক বছরেই প্রতি কেজিতে ১০-১৫ টাকার বৃদ্ধি!

সরকার কি কিছু করছে?

খাদ্য মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে, “মিনিকেট নামে চাল বাজারজাত করা যাবে না।” কারণ এটি কোনো বৈধ জাত নয়, বরং ব্যবসায়ীদের তৈরি করা একটি ব্র্যান্ড।

এছাড়া, সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য ওএমএস (ওপেন মার্কেট সেল), খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি এবং টিসিবির মাধ্যমে ৭ লাখ টন চাল বিতরণের পরিকল্পনা করেছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এসব উদ্যোগ আদৌ বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে কি?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের মনিটরিং ব্যবস্থা দুর্বল হলে এই ধরনের কৌশলগত কারসাজি রোধ করা কঠিন। বাজারের অসাধু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য কমাতে হলে নিয়মিত তদারকি ও কড়া নজরদারি প্রয়োজন।

ভোক্তারা কী করবেন?

চালের দাম নিয়ন্ত্রণের জন্য শুধু সরকার নয়, ভোক্তাদেরও সচেতন হতে হবে।
বিকল্প চাল ব্যবহার করুন: মিনিকেট চালের প্রতি নির্ভরশীলতা কমানো দরকার। নাজিরশাইল, স্বর্ণা, কিংবা স্থানীয় কৃষকদের উৎপাদিত মোটা চাল ব্যবহার করতে পারেন।
স্থানীয় কৃষকদের উৎসাহ দিন: স্থানীয় কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি চাল কেনার চেষ্টা করুন। এতে মধ্যস্বত্বভোগীদের কারসাজি কমবে।
বাজারের তথ্য জানুন: কোথায় কোন চাল কত দামে বিক্রি হচ্ছে, তা জেনে নিন। অনেক সময় কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ইচ্ছাকৃতভাবে দাম বাড়িয়ে ভোক্তাদের ঠকানোর চেষ্টা করেন।

উপসংহার

চালের বাজারে কারসাজি নতুন কিছু নয়, তবে এবারের পরিস্থিতি বেশ জটিল। মিনিকেট নামে বাজারে চাল বিক্রি করা আসলে একটি বাণিজ্যিক প্রতারণা। এর পাশাপাশি, ব্যবসায়ীদের মজুতদারি ও কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়ানোর প্রবণতা সাধারণ মানুষকে চরম বিপাকে ফেলেছে। সরকার যদি শক্ত পদক্ষেপ নেয়, নিয়মিত বাজার মনিটরিং করে এবং অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে, তাহলে এই পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব।

কিন্তু বড় প্রশ্ন থেকে যায়—বাজার কারসাজির এই খেলা কবে বন্ধ হবে? আর সাধারণ জনগণ কতদিন ধরে এই প্রতারণার শিকার হবে? আপনার মতামত কী? বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের ভূমিকা কতটা কার্যকর বলে আপনি মনে করেন?

নিউজ সোর্চ