Dhaka ০৯:১৮ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২০ মে ২০২৫
শিরোনাম :

মিয়ানমারের মর্মান্তিক সত্য: কিডনি বিক্রি করে বেঁচে থাকার লড়াই

  • Update Time : ০৫:৩১:২৮ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৬ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
  • / 98

২০২১ সালে মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে দেশটিতে চলমান গৃহযুদ্ধ ও অর্থনৈতিক সংকটের কারণে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা হয়ে উঠেছে দুর্বিষহ। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি, চাকরি হারানো এবং ঋণের বোঝা গ্রামবাসীদের এমন এক পরিস্থিতিতে ঠেলে দিয়েছে, যেখানে তাদের নিজেদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রি করে টাকা উপার্জন করতে হচ্ছে। সম্প্রতি ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, মিয়ানমারের অনেক গ্রামবাসী আর্থিক টানাপোড়েনে বাধ্য হয়ে অবৈধভাবে ভারতে গিয়ে কিডনি বিক্রি করছেন।

কিডনি বিক্রির পেছনের কারণ

মিয়ানমারের গ্রামীণ এলাকাগুলোতে দারিদ্র্য ও বেকারত্বের মাত্রা চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে দেশটিতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম আকাশচুম্বী হওয়ায় অনেক পরিবার ঋণের জালে আটকা পড়েছে। এই ঋণ পরিশোধের জন্য অনেকেই বিকল্প উপায় খুঁজছেন, যার মধ্যে একটি হল কিডনি বিক্রি করা।

মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুন শহর থেকে কয়েক ঘণ্টার দূরত্বে অবস্থিত একটি গ্রামের বাসিন্দা জেয়া (ছদ্মনাম) বিবিসিকে বলেন, “আমি শুধু একটি বাড়ি কিনতে এবং ঋণ পরিশোধ করতে চেয়েছিলাম। এই কারণেই আমি আমার কিডনি বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।” জেয়ার মতো আরও অন্তত আটজন গ্রামবাসী কিডনি বিক্রির জন্য ভারতে গিয়েছেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

কিডনি বিক্রির প্রক্রিয়া

মিয়ানমার ও ভারত উভয় দেশেই মানব অঙ্গ কেনা-বেচা সম্পূর্ণ অবৈধ। তবে দারিদ্র্য ও হতাশার সুযোগ নিয়ে একাধিক দালাল চক্র এই অবৈধ ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। জেয়া জানান, তিনি একজন দালালের মাধ্যমে কিডনি বিক্রির প্রক্রিয়া শুরু করেন। দালাল প্রথমে তার মেডিকেল পরীক্ষা করান এবং কয়েক সপ্তাহ পরে একজন সম্ভাব্য গ্রহীতার সন্ধান দেন। এরপর জেয়াকে ভারতে নিয়ে যাওয়া হয় অস্ত্রোপচারের জন্য।

দালালরা এই অবৈধ কার্যক্রমকে আইনের চোখে বৈধ করে তোলার জন্য জাল নথিপত্র তৈরি করে। জেয়া বলেন, “দালাল একটি জাল নথি তৈরি করেছিল, যেখানে আমার নামকে গ্রহীতার দূর সম্পর্কের আত্মীয় হিসেবে দেখানো হয়েছিল। এভাবে তারা আইনি জটিলতা এড়িয়ে যায়।”

ভারতে কিডনি প্রতিস্থাপনের আইনি জটিলতা

ভারতে কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য দাতা ও গ্রহীতাকে নিকটাত্মীয় হতে হবে অথবা তাদের পরোপকারী উদ্দেশ্য প্রমাণ করতে হবে। তবে এই আইনি বাধ্যবাধকতা সত্ত্বেও অবৈধ কিডনি প্রতিস্থাপনের ঘটনা বেড়েই চলেছে। ভারতে একাধিক চক্র এই অবৈধ ব্যবসার সাথে জড়িত, যারা দরিদ্র দেশগুলো থেকে মানুষ নিয়ে আসে এবং তাদের কিডনি বিক্রি করে।

এশিয়া জুড়ে অবৈধ মানব অঙ্গ ব্যবসা

মিয়ানমার ও ভারত ছাড়াও নেপাল, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, আফগানিস্তান এবং বাংলাদেশসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে অবৈধ মানব অঙ্গ ব্যবসা একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী কিডনি প্রতিস্থাপনের সংখ্যা ৫০% এরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতি বছর প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়, যা বিশ্বব্যাপী চাহিদার মাত্র ১০% পূরণ করে।

২০০৭ সালে ডব্লিউএইচও অনুমান করেছিল যে প্রতিস্থাপিত কিডনির ৫ থেকে ১০% কালোবাজার থেকে আসে। তবে বর্তমানে এই সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।

সমাধানের উপায়

এই সমস্যা সমাধানের জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। প্রথমত, মিয়ানমারের মতো দেশগুলিতে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা এবং দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। দ্বিতীয়ত, অবৈধ অঙ্গ ব্যবসা বন্ধ করতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সক্রিয় ভূমিকা প্রয়োজন। তৃতীয়ত, জনসচেতনতা বৃদ্ধি করে মানুষকে এই ধরনের অবৈধ কার্যক্রম থেকে বিরত রাখতে হবে।

উপসংহার

মিয়ানমারের গ্রামবাসীদের কিডনি বিক্রির ঘটনা শুধু একটি দেশের সমস্যা নয়, এটি বৈশ্বিক মানবাধিকার সংকটের একটি দিক। দারিদ্র্য ও সংঘাতের কারণে মানুষ যখন নিজের অঙ্গ বিক্রি করতে বাধ্য হয়, তখন তা সমগ্র মানবতার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এই সমস্যা সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসতে হবে এবং দরিদ্র দেশগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়তা করতে হবে।

এই প্রতিবেদনটি ট্রেন্ডবিডিনিউজের পাঠকদের জন্য তৈরি করা হয়েছে, যাতে তারা মিয়ানমার ও এশিয়ার অন্যান্য দেশের মানুষের দুর্দশা সম্পর্কে জানতে পারেন এবং এই সমস্যা সমাধানে সচেতনতা তৈরি করতে পারেন।

আপনার সোশ্যাল মিডিয়া এই পোস্ট শেয়ার করুন

Cricket Update

মিয়ানমারের মর্মান্তিক সত্য: কিডনি বিক্রি করে বেঁচে থাকার লড়াই

Update Time : ০৫:৩১:২৮ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৬ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

২০২১ সালে মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে দেশটিতে চলমান গৃহযুদ্ধ ও অর্থনৈতিক সংকটের কারণে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা হয়ে উঠেছে দুর্বিষহ। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি, চাকরি হারানো এবং ঋণের বোঝা গ্রামবাসীদের এমন এক পরিস্থিতিতে ঠেলে দিয়েছে, যেখানে তাদের নিজেদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রি করে টাকা উপার্জন করতে হচ্ছে। সম্প্রতি ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, মিয়ানমারের অনেক গ্রামবাসী আর্থিক টানাপোড়েনে বাধ্য হয়ে অবৈধভাবে ভারতে গিয়ে কিডনি বিক্রি করছেন।

কিডনি বিক্রির পেছনের কারণ

মিয়ানমারের গ্রামীণ এলাকাগুলোতে দারিদ্র্য ও বেকারত্বের মাত্রা চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে দেশটিতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম আকাশচুম্বী হওয়ায় অনেক পরিবার ঋণের জালে আটকা পড়েছে। এই ঋণ পরিশোধের জন্য অনেকেই বিকল্প উপায় খুঁজছেন, যার মধ্যে একটি হল কিডনি বিক্রি করা।

মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুন শহর থেকে কয়েক ঘণ্টার দূরত্বে অবস্থিত একটি গ্রামের বাসিন্দা জেয়া (ছদ্মনাম) বিবিসিকে বলেন, “আমি শুধু একটি বাড়ি কিনতে এবং ঋণ পরিশোধ করতে চেয়েছিলাম। এই কারণেই আমি আমার কিডনি বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।” জেয়ার মতো আরও অন্তত আটজন গ্রামবাসী কিডনি বিক্রির জন্য ভারতে গিয়েছেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

কিডনি বিক্রির প্রক্রিয়া

মিয়ানমার ও ভারত উভয় দেশেই মানব অঙ্গ কেনা-বেচা সম্পূর্ণ অবৈধ। তবে দারিদ্র্য ও হতাশার সুযোগ নিয়ে একাধিক দালাল চক্র এই অবৈধ ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। জেয়া জানান, তিনি একজন দালালের মাধ্যমে কিডনি বিক্রির প্রক্রিয়া শুরু করেন। দালাল প্রথমে তার মেডিকেল পরীক্ষা করান এবং কয়েক সপ্তাহ পরে একজন সম্ভাব্য গ্রহীতার সন্ধান দেন। এরপর জেয়াকে ভারতে নিয়ে যাওয়া হয় অস্ত্রোপচারের জন্য।

দালালরা এই অবৈধ কার্যক্রমকে আইনের চোখে বৈধ করে তোলার জন্য জাল নথিপত্র তৈরি করে। জেয়া বলেন, “দালাল একটি জাল নথি তৈরি করেছিল, যেখানে আমার নামকে গ্রহীতার দূর সম্পর্কের আত্মীয় হিসেবে দেখানো হয়েছিল। এভাবে তারা আইনি জটিলতা এড়িয়ে যায়।”

ভারতে কিডনি প্রতিস্থাপনের আইনি জটিলতা

ভারতে কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য দাতা ও গ্রহীতাকে নিকটাত্মীয় হতে হবে অথবা তাদের পরোপকারী উদ্দেশ্য প্রমাণ করতে হবে। তবে এই আইনি বাধ্যবাধকতা সত্ত্বেও অবৈধ কিডনি প্রতিস্থাপনের ঘটনা বেড়েই চলেছে। ভারতে একাধিক চক্র এই অবৈধ ব্যবসার সাথে জড়িত, যারা দরিদ্র দেশগুলো থেকে মানুষ নিয়ে আসে এবং তাদের কিডনি বিক্রি করে।

এশিয়া জুড়ে অবৈধ মানব অঙ্গ ব্যবসা

মিয়ানমার ও ভারত ছাড়াও নেপাল, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, আফগানিস্তান এবং বাংলাদেশসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে অবৈধ মানব অঙ্গ ব্যবসা একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী কিডনি প্রতিস্থাপনের সংখ্যা ৫০% এরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতি বছর প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়, যা বিশ্বব্যাপী চাহিদার মাত্র ১০% পূরণ করে।

২০০৭ সালে ডব্লিউএইচও অনুমান করেছিল যে প্রতিস্থাপিত কিডনির ৫ থেকে ১০% কালোবাজার থেকে আসে। তবে বর্তমানে এই সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।

সমাধানের উপায়

এই সমস্যা সমাধানের জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। প্রথমত, মিয়ানমারের মতো দেশগুলিতে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা এবং দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। দ্বিতীয়ত, অবৈধ অঙ্গ ব্যবসা বন্ধ করতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সক্রিয় ভূমিকা প্রয়োজন। তৃতীয়ত, জনসচেতনতা বৃদ্ধি করে মানুষকে এই ধরনের অবৈধ কার্যক্রম থেকে বিরত রাখতে হবে।

উপসংহার

মিয়ানমারের গ্রামবাসীদের কিডনি বিক্রির ঘটনা শুধু একটি দেশের সমস্যা নয়, এটি বৈশ্বিক মানবাধিকার সংকটের একটি দিক। দারিদ্র্য ও সংঘাতের কারণে মানুষ যখন নিজের অঙ্গ বিক্রি করতে বাধ্য হয়, তখন তা সমগ্র মানবতার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এই সমস্যা সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসতে হবে এবং দরিদ্র দেশগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়তা করতে হবে।

এই প্রতিবেদনটি ট্রেন্ডবিডিনিউজের পাঠকদের জন্য তৈরি করা হয়েছে, যাতে তারা মিয়ানমার ও এশিয়ার অন্যান্য দেশের মানুষের দুর্দশা সম্পর্কে জানতে পারেন এবং এই সমস্যা সমাধানে সচেতনতা তৈরি করতে পারেন।